Business is booming.

চার উদ্যোক্তার ‘সবজিগ্রাম’

করোনাকালের ‘ঘরবন্দী’ সময়ে নতুন কিছু শুরু করার পরিকল্পনা করেন চার তরুণ। কয়েক মাসের আলাপ–আলোচনার পর প্রাথমিকভাবে শাকসবজি বিপণনের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। তারপর বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন চার তরুণ। এভাবেই গত বছরের মার্চে হেমায়েতপুরে পাঁচ হাজার বর্গফুটের একটি ওয়্যারহাউস (গুদাম), একটি ট্রাক আর কয়েকজন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় ‘সবজিগ্রাম’–এর।

বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর ও যশোর থেকে প্রতিদিন ৩ টন সবজি ঢাকার উত্তরা, বনানী, মহাখালী, মিরপুর-৬ ও শ্যামলী কাঁচাবাজারের প্রায় অর্ধশত খুচরা সবজি বিক্রেতাকে সরবরাহ করে সবজিগ্রাম। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এ পরিমাণ বেড়ে সাড়ে ৪ থেকে ৫ টনে দাঁড়ায়। পাশাপাশি স্বনামধন্য একটি অনলাইন সুপারশপে প্রায় ১০০ ধরনের সবজি সরবরাহ করে চার তরুণের এ প্রতিষ্ঠান। এসব সবজি কৃষকের খেত থেকে সংগ্রহ করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা।

সবজিগ্রামের সহ–উদ্যোক্তা রাহাত কবির বলেন, ‘আমরা মূলত প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে ঢাকার বাজারের সংযোগ ঘটাতে চেয়েছি। কারণ, শাকসবজির সরবরাহব্যবস্থায় কৃষকের কাছ থেকে চার-পাঁচ হাত বদল হয়ে ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছায়। সে জন্য ভোক্তাকে বেশি দামে সবজি কিনতে হয়, অন্যদিকে কৃষকও ন্যায্য দাম পান না। আমরা কৃষকের খেত থেকে বাছাই করা সবজি বাজারদরের চেয়ে কেজিতে তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি দরে কিনে থাকি। বাছাই করে মানসম্মত সবজি কিনছি বলে আমাদেরও বাড়তি অর্থ দিতে সমস্যা হচ্ছে না। অন্যদিকে সেই সবজি বিক্রির জন্য আড়ত বা হাটে নিতে হচ্ছে না বলে কৃষকেরও ব্যয় কমেছে।’

সবজিগ্রামের উদ্যোগ ও পথচলা নিয়ে ১৯ অক্টোবর কথা হয় রাহাত কবিরের। সঙ্গে ছিলেন আরেক সহ–উদ্যোক্তা খন্দকার আসাদুজ্জামান। এই স্টার্টআপের অন্য দুই উদ্যোক্তা হলেন কাজল মহারাজ ও মুনতাসীর হাফিজ। প্রথম তিনজন বন্ধু। আর মুনতাসীর হচ্ছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি রাহাত কবিরের চাচাতো ভাই। সবজিগ্রাম শুরুর আগে রাহাত ও আসাদুজ্জামান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। কাজল মহারাজ ছিলেন ফ্রিল্যান্সার। আর মুনতাসীর ছিলেন প্রবাসে।

শুরুর দিকের কথা বলতে গিয়ে রাহাত কবির বলেন, ‘সারা দেশেই কমবেশি সবজি হলেও ঢাকায় নির্দিষ্ট কিছু জেলা থেকে সবজি আসে। কারণ, রাজধানীতে সাধারণত আকারে বড় ও নিখুঁত চেহারার সবজির চাহিদা বেশি। ফলে কোন জেলা থেকে সবজি আসে এবং বেচাকেনা কীভাবে হয়, সেটি জানতে আমরা প্রথমে কারওয়ান বাজারের আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলতে যাই। কিন্তু তাঁদের কাছে আমরা পাত্তা পাচ্ছিলাম না। পরে আমরা বুদ্ধি করে ট্রাকচালকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলি। এভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা উত্তরা ও যাত্রাবাড়ীতেও যাই। এই তিন বাজারে কয়েক রাত কাটানোর পর আমরা শাকসবজির সরবরাহব্যবস্থা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাই।’

প্রথমে উত্তরার বিডিআর, ১১ ও ১৪ নম্বর বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীদের সবজি সরবরাহ করার পরিকল্পনা করে সবজিগ্রাম। কিন্তু সেখানেও নানা চ্যালেঞ্জ। খন্দকার আসাদুজ্জামান বলেন, ‘কাঁচাবাজারের সবজি ব্যবসায়ীরা ভোররাতে পাইকারি বাজার থেকে পণ্য কিনে আনেন। তারপর সারা দিন বিক্রি করেন। আমরা যখন তাঁদের সবজি বিক্রির প্রস্তাব দিলাম, তখন খুচরা বিক্রেতারা বললেন, তাঁরা আমাদের কাছ থেকে কেন নেবেন! আমরা তাঁদের বোঝালাম, মানসম্মত পণ্য পাইকারি বাজারের চেয়ে কম দামে আমরা পৌঁছে দেব। এভাবেই আমাদের সবজি অল্প অল্প করে নিতে শুরু করলেন ব্যবসায়ীরা।’

উত্তরার পর ধাপে ধাপে বনানী, মহাখালী, মিরপুর-৬ ও শ্যামলী কাঁচাবাজারে পৌঁছে গেছে সবজিগ্রাম। এই পাঁচ বাজারের অর্ধশত খুচরা ব্যবসায়ী প্রতিদিন সকালে সবজিগ্রামের অ্যাপের মাধ্যমে সবজির চাহিদা জানিয়ে দেন। সে অনুযায়ী মুন্সিগঞ্জ, সিঙ্গাইর ও যশোর থেকে সবজি সংগ্রহ করে হেমায়েতপুরের ওয়্যারহাউসে নিয়ে আসা হয়। সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে পরদিন সকালে সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে প্রায় শতাধিক কৃষক সবজিগ্রামে শাকসবজি সরবরাহ করেন। যদিও প্রায় দেড় হাজার কৃষকের সঙ্গে নিবন্ধনপ্রক্রিয়া শেষ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে সবজিগ্রামে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ৩৫।

দেশের বাজারের পাশাপাশি বিদেশেও সবজি রপ্তানি শুরু করেছে সবজিগ্রাম। চলতি মাসের গোড়ার দিকে ২৪ হাজার কেজি এলাচি লেবু সমুদ্রপথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে পাঠিয়েছে তারা। এই বিপুল পরিমাণ লেবু সংগ্রহ করতেও বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সবজিগ্রামকে। পাঁচ জেলা ঘুরে শেষ পর্যন্ত ময়মনসিংহ থেকে ৫ হাজার কেজি ও নাটোর থেকে ১৯ হাজার কেজি সংগ্রহ করে মোড়কজাত করে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জাহাজে তুলে দেওয়া হয়।

৪০ লাখ টাকা মূলধনে শুরু করা সবজিগ্রামে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন চার উদ্যোক্তা। সম্ভাবনা কেমন? এমন প্রশ্নের জবাবে রাহাত কবির বলেন, ‘আমরা প্রথম দিন থেকেই অল্প হলেও মুনাফা করছি। প্রথম দিন ২৫ হাজার টাকা মুনাফা করেছিলাম। ফলে ভালো সম্ভাবনা আছে।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমরা বিষমুক্ত সবজি সরবরাহে জোর দিতে চাই। প্রথম দিন থেকেই সেটি করার চেষ্টা করেছি। কোনো কৃষক ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পর নির্দিষ্ট সময় পার না হলে আমরা তাঁর কাছ থেকে সবজি সংগ্রহ করি না। ইতিমধ্যে আমরা অল্পসংখ্যক কৃষককে কিছুটা হলেও সুফল দিতে পেরেছি। আগামী দিনে সংখ্যাটি বাড়াতে চাই।’

মতামত দিন