Business is booming.

নির্মাণশ্রমিকেরা কি এভাবে মারা যেতেই থাকবেন?

সোসাইটিতে বর্তমানে ৩৫ থেকে ৪০টি ১০ তলা ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। দুঃখজনক বিষয় হলো একটিতেও বাংলাদেশ জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধি অনুযায়ী শ্রমিক ও পথচারীদের ন্যূনতম নিরাপত্তার ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। অথচ গত ২৮ অক্টোবর এই সোসাইটির ‘এ’ ব্লকে নির্মাণাধীন একটি ভবনের ৫ম তলা থেকে পড়ে একজন নির্মাণশ্রমিক নিহত হয়েছেন। দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই শ্রমিকের নাম মো. আনিস মিয়া (৩০), বাড়ি কিশোরগঞ্জে, সপরিবারে থাকতেন সাভারেই।

সোসাইটিতে সরেজমিনেও কোনো শ্রমিকের সঙ্গে নিরাপত্তাসরঞ্জাম চোখে পড়েনি। ৮ থেকে ১০ তলা উঁচুতে বাঁশের চাটাইয়ে দাঁড়িয়ে শ্রমিকেরা এক হাতে রড ধরে আরেক হাতে মিক্সার ঢালছেন, প্লাস্টার করছেন। কোনো নির্মাণাধীন ভবনেরও চারপাশ জাল দিয়ে মোড়ানো দেখা যায়নি। বলা যেতে পারে একেবারে উন্মুক্ত। এতে ইটের টুকরা, প্লাস্টারের ভাঙা অংশ, রড, কাঠ, বাঁশসহ নানা প্রকার নির্মাণসামগ্রী নিচের সড়কে ছিটকে পড়ছে। অঘটন বলে-কয়ে আসে না। নিচে চলাচল করা কারও মাথায় যদি এর কোনো একটি টুকরাও পড়ে, তাহলে ভাবুন তো অবস্থা কী হবে? সেখানে বসবাস করা কয়েকজন একই শঙ্কার কথা জানালেন। আর কোনো শ্রমিক ওপর থেকে পড়লে তাঁর অবস্থা কী হবে, তা বলার প্রয়োজন নেই।

পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক দশক আগে এই আবাসন প্রকল্প প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিমধ্যে অনেকগুলো বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যাংকারসহ অনেকে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেছেন। তবে এর ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। প্রকল্পের অধিকাংশ প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিকানায় রয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক, সাবেক ও বর্তমান আমলা, প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও ব্যাংকাররা। তাঁদের দ্বারাই এ প্রকল্পের নিয়মনীতি প্রণয়ন ও পরিচালিত হয়। ‘প্রোফাইল’ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এ আবাসনের নীতিনির্ধারকের সমাজের উঁচু শ্রেণির শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সদস্য, যাঁরা নিজেদের সচেতন বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাহলে প্রশ্ন তোলাই যায়, কেন এমন একটি প্রকল্প হবে ‘মৃত্যুর ফাঁদ’?

কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া চলছে নির্মাণকাজ। দুর্ঘটনার আশঙ্কায় সড়ক চলাচলরত মানুষ। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর কো–অপারেটিভ সোসাইটিতে

কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া চলছে নির্মাণকাজ। দুর্ঘটনার আশঙ্কায় সড়ক চলাচলরত মানুষ। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর কো–অপারেটিভ সোসাইটিতে
ছবি: প্রথম আলো

যা বলছে আইন

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি) সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বহুতল ভবনে (২০ মিটার উঁচু তথা ৬ তলা বা তদূর্ধ্ব ভবন) নির্মাণশ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাথায় হেলমেট, কোমরে সেফটি বেল্ট, পায়ে রবারের জুতা, ঢিলেঢালা পোশাক ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া পথচারীদের নিরাপত্তার জন্য নির্মাণকাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাইলনের জাল দিয়ে পুরো নির্মাণাধীন ভবন ঢেকে দিতে হবে। সড়ক থেকে কমপক্ষে ১ দশমিক ৫ মিটার দূরত্বে নির্মাণাধীন ভবনকে অবশ্যই ২ দশমিক ৪ মিটার উঁচু বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে। ভবনের চারপাশে পর্যাপ্ত জায়গা রেখে টিন দিয়ে অস্থায়ী মাচা (কেনোপি) বানানোর বিধান রয়েছে আইনে।

ইমারত নির্মাণ আইন-১৯৫২, জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৬, ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা-২০০৮—প্রভৃতি আইন ও বিধানে নির্মাণশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্ব নির্ধারণ করা আছে। শ্রম আইন অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়োগকারীদের।

প্রসঙ্গত, এ অঞ্চলের জন্য ১৯৫২ সালে প্রথম ‘বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করা হয়। ১৯৯৩ সালে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ প্রণয়ন করা হয়। ১৯৯৩ সালের বিল্ডিং কোড ২০০৬ সালে গেজেটভুক্ত করা হয়। এ পর্যায়ে বিএনবিসিতে অনেক নতুন বিষয় যুক্ত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে ‘সংশোধিত বিএনবিসি’ প্রণয়ন করা হয়। সর্বশেষ নানা পক্ষের দাবির মুখে ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)-২০২০ গেজেটভুক্ত করা হয়।

সচেতন মহলের কিছু চিত্র

১. পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে সপ্তাহের ব্যবধানে দুজন নির্মাণশ্রমিক নিহত হন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। তাঁদের মধ্যে ১৭ সেপ্টেম্বর নিহত হন হাফিজুর রহমান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক ভবনে কাজ করার সময় নিচে পড়ে প্রাণ হারান। এর ৮ দিনের মাথায় ২৫ সেপ্টেম্বর ছাত্রদের জন্য নির্মাণাধীন ১০ তলা হলের ওপর থেকে পড়ে নিহত হন নির্মাণশ্রমিক নুর আলম।

২. ২০২১ সালের ২৭ মে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ রফিক-জব্বার হলসংলগ্ন ২২ নম্বর নির্মাণাধীন হলের ছয়তলা থেকে পড়ে নিহত হন নির্মাণশ্রমিক শাহের আলী (২৫)। তিনি ছিলেন কুড়িগ্রাম জেলার কচাকাটা থানার বাসিন্দা।

৩. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি সংস্কারাধীন অডিটোরিয়ামে কাজ করার সময় নিচে পড়ে নিহত হন নির্মাণশ্রমিক আলেক আলী (৩৫)। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকজন নির্মাণসংশ্লিষ্ট কর্মীর মৃত্যু হয় গত ৩১ মে। নির্মাণাধীন ২০ তলা একাডেমিক ভবনে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করার সময় সাগর নামের ওই শ্রমিক বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান।

বছরে নির্মাণশ্রমিক প্রাণ হারাচ্ছেন

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, দেশে ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে কর্মস্থলে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৩৭৭ জন নির্মাণশ্রমিক। তাঁদের মধ্যে ২০১৭ সালে নিহত হন ১৩৪ জন। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮৪, আর ২০২১ ছিল ১৫৪। ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ১৩৪ জন। অর্থাৎ, দিন দিন কর্মস্থলে নির্মাণশ্রমিকের প্রাণহানি বাড়ছে। কারণ, ২০০২ থেকে ২০১৭—এই ১৫ বছরে গড়ে ৯২ জন নিহত হয়েছেন। কিন্তু ২০১২ (২০১২ সালসহ) থেকে ২০২১—১০ বছরে এই গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৪ জনে।

বিলস বলছে, দেশে বছরে বিভিন্ন খাতে যেসংখ্যক শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে, তার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নির্মাণ খাত। সবার ওপরে আছে পরিবহন খাত।

আর ইমারত শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৭৩৯ জন নির্মাণশ্রমিক কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তাদের হিসাব অনুযায়ী, বছরে কমবেশি ১২০ জন নির্মাণশ্রমিক নিহত হচ্ছেন।

কথায় আছে ঘুমিয়ে থাকা মানুষকে জাগিয়ে তোলা যায়। কিন্তু যিনি ঘুমের ভান করেন, তাঁকে জাগানো যায় না। ঠিক যাঁরা সমাজের সচেতন জনগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে পরিচিত, তাঁদের কি ইচ্ছে করলেই সচেতন করা যায়? না, যায় না। যদি না তাঁরা নিজেরা সচেতন হন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন আর মানবিক হন। বহুতল ভবন নির্মাণসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

প্রাণহানির তুলনায় আহত হওয়া নির্মাণশ্রমিকের সংখ্যাও অনেক। হতাহত এই শ্রমিকদের পরিবারের কথা একবার ভাবুন তো। একবার বয়সের দিকে তাকিয়ে দেখুন না! বেশির ভাগই যুবা। অর্থাৎ সচেতন মহলের অসচেতনতার কারণে বা লোভের বলি হচ্ছেন তাঁরা। আর আমৃত্যু এর খেসারত ভোগ করে যান তাঁদের স্বজনেরা। কারণ, তাঁদের বেশির ভাগই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

মতামত দিন