Business is booming.

নাগরিকদের মানুষ করতে না পারলে উন্নয়ন টেকসই হবে না

মোহাম্মদ আমান উল্লাহ আমান

স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পার করছে বাংলাদেশ। এই বায়ান্ন বছরে দেশের উন্নয়ন হয় নি একথা বলার কোন সুযোগ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই অনেক উন্নয়ন হয়েছে। দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে। জনসংখ্যার প্রয়োজন অনুযায়ী বেড়েছে খাদ্য উৎপাদন, ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়), রাস্তাঘাট, যানবাহন, শহর-বন্দর, উচু উচু দালানকোঠা, অট্টালিকা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, আমদানি-রপ্তানি, অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, অর্থনীতির আকার ইত্যাদি। আরো বেড়েছে আমলা, রাজনীতিবিদ এবং আমজনতা। আসলে বস্তুগত উন্নতির ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। উন্নতি হয়নি কেবল মানুষের। এদেশের মানুষের চরিত্রের উন্নতি হয়নি, চিন্তার উন্নতি হয়নি, মেধার উন্নতি হয়নি, কর্মক্ষমতার উন্নতি হয়নি, বিশ্লেষণী ক্ষমতার উন্নতি হয়নি, উদ্ভাবনী ক্ষমতার উন্নতি হয়নি, দায়িত্বশীলতার উন্নতি হয়নি, সচ্ছতাবোধ ও জবাবদিহিতাবোধের উন্নতি হয়নি, আবেগের উন্নতি হয়নি, শৃঙ্খলাবোধের উন্নতি হয়নি, দেশাত্ববোধের উন্নতি হয়নি, মমত্ববোধের উন্নতি হয়নি, ভাতৃত্ববোধের উন্নতি হয়নি ইত্যাদি। লিখতে গেলে এক এক করে আরো অসংখ্য পয়েন্ট চলে আসবে যেখানে মানুষের শুধু অবনতির চিত্রই ফুটে উঠবে। অথচ বস্তুগত উন্নয়নের চেয়ে মানুষের উন্নয়ন করার দরকার ছিল সবার আগে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকগণ ও নেতৃবর্গ এবং পরামর্শকগণ রাষ্ট্রের উন্নয়ন (অর্থনৈতিক উন্নয়ন) নিয়ে ভেবেছেন, কিন্তু রাষ্ট্রের উন্নয়নকে যারা তরান্বিত করবে, উপভোগ করবে এবং প্রতিনিধিত্ব করবে তাদেরকে যোগ্য করে তোলার কোন উদ্যোগ কেউ গ্রহণ করেনি। এদেশের মানুষ ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা এবং অন্যায়ের বিপক্ষে প্রতিবাদ করা ভুলে গেছে। কিভাবে অর্থ উপার্জন করতে হয় জানেনা। অমাদের পরিবারে, সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অথবা কর্মস্থলে, কোথাও কেউ মানুষকে মানুষ হতে শিখায় না। জাতির পিতা একবার বাঙালিদের মানুষ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাকেও সেই কাজটুকু করতে দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর পরে আহমদ ছফা ছাড়া এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে আর কাউকে তেমন একটা দেখা যায়নি। যদিও বর্তমান সময়ে সলিমুল্লাহ খানের কিছু অপ্রাতিষ্ঠানিক কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবর্তিত হতে দেখা যায়।

এই যে মানুষের উন্নয়ন নিয়ে দেশে কিছু হয়নি বা এখনও হচ্ছেনা তার ফলা কি অথবা ভবিষ্যতে কি হতে পারে? মুশকিল হলো ফলাফল যতটুকু ভয়াবহ হয়েছে আর ভবিষ্যতে আরও কতটুকু ভয়াবহ হতে পারে তার বুঝার মতো বোধশক্তিও আমাদের তৈরি হয়নি। এই বোধশক্তিহীন মানুষেরা ক্ষেত খাওয়া বেড়া হয়ে গেছে। একটু একটু করে তারা রাষ্ট্রের উন্নয়নকে খাচ্ছে। কৃষক অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করে, শিল্পোৎপাদক অস্বাস্থ্যকর উপাদান দিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অস্বাস্থ্যকর পণ্য উৎপাদন করে জাতিকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। ব্যবসায়িরা সিন্ডিকেট করে অথবা ভেজাল করে মানুষকে বিপদে ফেলছে অথবা ওজনে কম দিয়ে ক্রেতার সাথে প্রতারণা করছে। শ্রমিকেরা কাজে ফাকি দিয়ে নিয়োগকর্তাকে ঠকায়, আবার নিয়োগকর্তা ন্যায্য মজুরী না দিয়ে শ্রমিক ঠাকায়। শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে পাঠদান বাদ দিয়ে টিউশন অথবা তোষামোদের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, আর শিক্ষার্থীরা ছুটে মানুষ হওয়া বাদ দিয়ে সিজিপিএ – এর পিছনে। অর্থশক্তি অথবা পেশিশক্তির কাছে বিচারকের রায় নতি স্বীকার করে, বিত্তশালী অপরাধীরা টাকা দিয়ে কিনে নেয় আইন। রাজনীতিবিদরা জনকল্যাণ ছেড়ে নিজের কল্যাণ নিয়ে বেশি ব্যস্ত। লোভে পড়ে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা ফরেন কারেন্সি দেশে পাঠানোর পরিবর্তে তুলে দেন বেগম পাড়ার স্যারদের হাতে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা প্রভু হয়ে অবির্ভূত হন প্রজাদের সামনে। নাদান প্রজারাও তাদের সম্মানে গদগদ। তাদের ক্ষমতা আর উপরি আয় দেখে সদ্য পাশ করা গ্রেজুয়েটও স্বপ্ন দেখে প্রজাতন্ত্রের প্রভু হওয়ার। তেমনিভাবে ভক্তের হাদিয়ায় ধর্ম ব্যবসায়িরা উপভোগ করেন আয়েশী জীবন। এসব অসঙ্গতি নিয়ে যাদের লেখার কথা সেই সাংবাদিকরা আজ হলুদ জার্সি গায়ে পড়ে আছে। আর এভাবেই দেশের উন্নয়নকে একটু একটু করে খেয়ে শেষ করছে কোটি কোটি ক্ষেত খাওয়া বেড়া। পরের প্রজন্ম এসে কোন সমাজে বসবাস করবে আর কি খাবে তা ভেবে আমি সত্যিই আতঙ্কিত। তারা এসে আদৌ কল্যাণকর কিছু পাবে কি না তা উপরওয়ালাই ভালো জানেন।

যাহোক যেভাবেই হোক এত বছরে মানুষের উন্নয়ন নিয়ে এদেশে কিছু হয়নি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এত বছরেও এই রাষ্ট্রে কোন সমাজ বিজ্ঞানীর জন্ম হয়নি যিনি এই বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারেন। ফলে যেই জায়গা থেকে উন্নয়ন শুরু করা দরকার ছিল সেই জায়গা থেকে শুরু করা হয়নি। তারপর আবার চলে গেছে বায়ান্ন বছর। আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। আজকে থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। মানুষ উন্নয়নের কাজ। আজকে উদ্যোগ নিলেও অবস্থা ঠিক হতে দুই যুগ লাগবে। অন্যথায় রাষ্ট্রের এই বস্তুগত উন্নয়ন টেকসই হবে না।

লেখকঃ

উদ্যোক্তা অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

চেয়ারম্যান, এন্টারপ্রাইজ ৩৬০ লিমিটেড ও স্কুল অব অন্ট্রুপ্রেনিউরশীপ ডেভেলপমেন্ট।

মতামত দিন