Business is booming.

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের যে ভুলে বিপদের দিকে দেশ

মোহাম্মদ আমান উল্লাহ আমান

বলা হয় বাংলাদেশকে টিকিয়ে রেখেছেন তিন প্রকারের পেশাজীবী মানুষ। আর তারা হলেন কৃষি শ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী এবং প্রবাসী শ্রমিক। তাদের শ্রম আর ঘামের উপর দাড়িয়ে আছে এদেশের সাড়ে ষোল কোটি (সরকারি হিসেবে) আমার মতে একুশ কোটি মানুষের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার ভাগ্য। আমাদের কৃষকরা আমাদের জন্য খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন করেন। কিন্তু তারা যে পরিমাণ খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল বাজারে যেগান দিয়ে থাকেন তাতে আমাদের সামষ্টিক চাহিদা পূরণ হয় না। আমাদের কৃষি জমির অপ্রতুলতা, জমির ব্যবহারে অদক্ষতা এবং সনাতন কৃষি পদ্ধতির প্রয়োগ এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। সুতরাং বাধ্য হয়ে আমাদেরকে বিদেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করে জনগণের চাহিদা মিটাতে হয়। আর বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে লাগে বৈদেশিক মুদ্রা যার যোগান দিয়ে থাকেন আমাদের প্রবাসী শ্রমিক ভাইয়েরা যাদেরকে আমরা রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবে সম্মান জানাই এবং গার্মেন্টস কর্মীরা যাদের জন্য এখনও আমরা কোন সম্মান সূচক শব্দ আবিষ্কার করতে পারিনি। এখানে উল্লেখ্য যে আমরা আমাদের কৃষকদের জন্যও কোন সম্মান সূচক শব্দ আবিষ্কার করতে পারিনি। জানিনা এই ব্যর্থতা কার।

যাহোক যে প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম সেখানে ফিরে আসি। আমাদের যে খাদ্যপণ্য, শিল্পপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারি আমদানি করার জন্য যা বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয় তার একটি বড় অংশের যোগান দিয়ে আসছেন আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা ভাইয়েরা। দেশের উন্নয়নে তাদের অবদান অনন্য। কিন্তু তাদের এই অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে তাদের অনেকের না বুঝা কিছু ভুল। বাংলাদেশে দেশবিরোধী একটি চক্র স্বাধীনতার ঠিক পর থেকেই কাজ করছে। এখনও তা অনেক শক্তিশালী। এই চক্রটি দেশের উন্নয়নকে নস্যাৎ করতে চায়। দেশের চেয়ে তাদের বিদেশ প্রীতি বেশি। দেশের সম্পদ লুটপাট করে তারা বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ সম্পদ বিদেশে পাচার করার জন্য তারা আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ব্যবহার করছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধারাও কিছু টাকা বেশি পাওয়ার লোভে তাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রাগুলো তুলে দিচ্ছেন অর্থ পাচারকারীদের হাতে। তারা হয়তো বুঝতে পারছেন না যে এর কারণে রাষ্ট্রের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে এবং তারা নিজেরাও কত বড় ক্ষতির মধ্যে পড়ছেন।

প্রথমত তারা রাষ্ট্রের সম্পদ পাচার করার ক্ষেত্রে পাচারকারী তথা দুর্নীতিবাজ তথা দেশ বিরোধী শক্তিকে সহায়তা করছেন। অর্থ পাচার সহজ হওয়ার কারণে দুর্নীতিবাজরা আরও বেশি দুর্নীতি করার সাহস এবং সুযোগ পাচ্ছে। ফলে রাষ্ট্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানেই জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যেহেতু রাষ্ট্রর মালিক জনগণ। ভুল করা রেমিট্যান্স যোদ্ধা নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের একজন নাগরিক হওয়ার সুবাদে। দেশাত্মবোধ না থাকলে এই ক্ষতি উপলব্ধি করা কঠিন।

কিন্তু যে ক্ষতি উপলব্ধি করা সহজ তা হলো রেমিট্যান্স যোদ্ধার সরাসরি আর্থিক ক্ষতি। সামান্য টাকা বেশি পাওয়ার লোভে অর্থ পাচারকারীদের হাতে বৈদেশিক মুদ্রা তুলে দিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক-ভাবে কয়েক গুণ বেশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করা দরকার। ধরুন বৈধ পথে ১ মার্কিন ডলার দেশে পাঠালে ১০৭ টাকা পাওয়া যায়। আর পাচারকারীদের কাছে বিক্রয় করলে পাওয়া যায় ১১৭ টাকা। বেশি পাওয়া যায় ১০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ১০ হাজারে বেশি পাওয়া যায় ১০০০ টাকা। অন্যদিকে তার এই ডলার দেশে না আসার কারণে দেশে তৈরি হচ্ছে ডলারের ঘাটতি। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছেনা। আমদানির পরিমাণ কমে গেছে। কিছু কিছু আমদানি-কারক খোলা বাজার থেকে বেশি দামে ডলার কিনে সীমিত পরিসরে আমদানি করছে। ফলে তাদের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। সেই সাথে বাজারে পণ্যের যোগানও কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে ভোগ্য পণ্যের দামে। প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। রেমিট্যান্স যোদ্ধার পরিবার কিন্তু এই কয়েক গুণ বাড়তি দামেই পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। ১০ টাকা লাভ করতে গিয়ে ১০০ টাকা জরিমানা দিচ্ছেন। তাদের ভুলের কারণে সমাজের অন্যদেরও এই বাড়তি দামের চাপ মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে।

বিষয়টি বুঝতে পারলে হয়তো এমন ভুলটি করতেন না তারা। আমার মনে হয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তা নিয়ে তাদের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন নাগরিকদেরও এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ প্রবাসে কাজ করছেন। তাদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সঠিভাবে দেশে আনা গেলে সংকট দ্রুত প্রশমিত হবে।

 

লেখকঃ

উদ্যোক্তা অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

চেয়ারম্যান, এন্টারপ্রাইজ ৩৬০ লিমিটেড ও স্কুল অব অন্ট্রুপ্রেনিউরশীপ ডেভেলপমেন্ট।

মতামত দিন